সিরাত
জীবনজুড়েই যে চুক্তি মানতে হয়
POSTED ON Nov 16, 2021

আমি আপনাদের সামনে আমার প্রিয় অ্যালবাম থেকে ভিন্ন ধরনের তিনটি ছবি পরপর উপস্থাপন করব। এর মাধ্যমে আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন, আমাদের চলমান দাওয়াতি কাজের বরকতে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে কী কল্যাণ অর্জন করতে পারব।
মক্কা থেকে মদিনার পথে ছোট্ট একটি প্রান্তর ছিল, নাম বদর। এর ওপর দিয়ে একটি পথ গিয়ে লোহিত সাগরের তীরে মিশেছে। আর মদিনা লোহিত সাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় সাগরের বাতাসের একটি রেশ মদিনা শহরের মানুষও উপভোগ করতে পারে। বদর নামক এলাকায় বালুকাময় বিস্তীর্ণ এলাকা রয়েছে। আরও আছে বেশ কিছু পাহাড় এবং পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা।
এই এলাকায় দ্বিতীয় হিজরিতে এমন এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে যায়, যা মানবতার ইতিহাসকে আমূল পালটে দেয়। মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে জীবন্ত এক ইতিহাসের সূতিকাগার তৈরি করে দেয়। হক আর বাতিলের প্রথম ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এখানেই। একদিকে ছিল অন্ধকার আর অজ্ঞতায় ডুবে থাকা মক্কার সব শক্তিমান নেতৃবৃন্দ, আর অপরদিকে আল্লাহর দ্বীনের পতাকাবাহী গুটিকয়েক মুসলিম সেনারা।
এর আগে, দীর্ঘ পনেরো বছর রাসূল সা. দাওয়াতি কাজ করার পর যে সামান্য কিছু লোক সাড়া দিয়েছিল, তারাই অংশ নিয়েছিল এই যুদ্ধে। মুসলিম সেনাবাহিনীতে মক্কায় সাড়া দেওয়া প্রাথমিক সময়ের মুসলিম যেমন ছিলেন, তেমনি হিজরতের পর ইসলামের ছায়াতলে আসা মদিনার বেশ কিছু আনসার সাহাবিও ছিলেন। কাফির বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপরে। তাদের ঘোড়া, তরবারি আর অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের কোনো কমতি ছিল না। অন্যদিকে সত্য পথের পথিকদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। সাথে ছিল দুটি ঘোড়া আর অপ্রতুল যুদ্ধাস্ত্র।
সাদ বিন মুয়াজ রা. একটি পাহাড়ের টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাসূল সা.ও সেই টিলার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রিয় সাথি আবু বকর সিদ্দিক রা.। সেদিন সাহাবিরা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। তাদের মনে সুপ্ত আশা-- নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য আসবে। অন্যদিকে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও সেদিন সকল সাহাবির চোখে বাড়তি নিদ্রা দিয়ে দিলেন, যেন তাদের শরীর ও মন প্রয়োজনমতো বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারে। একজন মানুষ কেবল জেগে রইলেন। তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল সা.। তিনি ইবাদতে আর দুআয় সময় পার করলেন। যে আল্লাহ তায়ালা তাকে রিসালাতের গুরু দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন, সেই আল্লাহর সামনেই তিনি পড়ে রইলেন।
সেদিন ছিল মারাত্মক এক পরিস্থিতি। কারণ,
তাওহিদ
পৃথিবীতে টিকে থাকবে কি না, তা নির্ধারণ করার
জন্য তাওহিদের পক্ষে মাত্র কয়েকশো মানুষ সেদিন দাঁড়িয়েছিল। এই বাস্তবতা রাসূল সা.
যথার্থভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। তাই তিনি সিজদায় পড়ে শুধু কান্নাকাটিই করছিলেন আর
বলছিলেনÑ “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে
দেওয়া আপনার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করুন।” নবিজি সা. এত নিবিষ্ট মনে সিজদায় ছিলেন, যে তাঁর গায়ের পোশাক কাঁধের দিক থেকে খুলে
গিয়েছিল, অথচ তিনি টেরও পাননি। তিনি
তাঁর মাথা সিজদায় অবনত রেখেছিলেন আর দুআ করছিলেন,
“হে আল্লাহ! আজ এই মুসলিমরা যদি পরাজিত হয়, তাহলে আপনার ইবাদত করার মতো আর কেউ এই পৃথিবীতে টিকে থাকবে না।”
কথাটি খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক, কিন্তু কথার নেপথ্যে যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তা একটু লক্ষ করুন। এখানে উম্মাহর অস্তিত্বের প্রয়োজনকে শর্ত হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। রাসূল সা. দুআ করেছেন এভাবে, “আজ যদি মুসলিমরা হেরে যায়, তাহলে আপনার ইবাদত করার মতো আর কেউ এই পৃথিবীতে থাকবে না।”
এই কথাটিকে এভাবেও বলা যায়, আজকে যদি এই
মানুষগুলোকে আপনি বিজয়ী করেন, যদি তারা বেঁচে
থাকে, তাহলে তারা এবং তাদের
পরবর্তী উত্তরসূরিরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আপনার ইবাদত করবে এবং মানুষকে আল্লাহর
পথে আহ্বান করার কাজেই নিজেদের গোটা জীবনকে বিনিয়োগ করবে।
রাসূল সা.-এর সেই দুআটি মূলত এক ধরনের অনুরোধ ছিল। একইসঙ্গে এক ধরনের আকাক্সক্ষা এবং এক ধরনের প্রতিজ্ঞাও ছিল। খেয়াল রাখতে হবে, রাসূল সা. একটিবারের জন্যও বলেননি, আজ বিজয়ী না হলে উম্মাহর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে, আমাদের সমস্ত প্রতিষ্ঠান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা আমাদের সম্পত্তি ও উপার্জন কমে যাবে। দুনিয়াবি এসব কোনো শর্ত বা চাহিদাই তিনি সেদিন প্রকাশ করেননি। কারণ তিনি জানতেন, এসব দুনিয়াবি অর্জন যদি টিকেও থাকে, তারপরও সেদিনের পরাজয় আল্লাহর সাথে বান্দার চিরন্তন সম্পর্ককেই নষ্ট করে দেবে। অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টির নেপথ্যে যে প্রাকৃতিক চেতনা বা বিশ্বাস, তা থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই চেতনা না থাকলে যে সংস্কৃতি তৈরি হবে কিংবা যে উন্নয়ন হবে, তা প্রকারান্তরে মানুষকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যাবে। দ্বীনি চেতনা না থাকলে বাকি সব তথাকথিত উন্নয়ন দিয়ে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হবে না।
প্রকৃত বাস্তবতা হলো, মানুষ সৃষ্টির সময় আল্লাহ তাঁর এই বান্দার সাথে যে চুক্তি করেছিলেন, বদরের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা নতুন করে নবায়ন করা হয়েছিল। এ কারণেই বদরের দিনটিকে হক ও বাতিলের মধ্যে ফয়সালার দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এতক্ষণ যে ছবিটির কথা আলোচনা করলাম, তা দেখে নিজেকে বারবার কেবল এই প্রশ্নগুলোই করা উচিতÑ আমরা কি নিজেদের কখনও এভাবে পরিচালনা করতে পেরেছি, যার ফলে আমরা আল্লাহর সামনে আমাদের পুরোপুরি সমর্পণ করতে পারি? আমাদের কাছে সফলতার সংজ্ঞা কী? আমরা কি আল্লাহর খলিফা হিসেবে, শ্রেষ্ঠতম দ্বীনের ধারক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পেরেছি? ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং পরকালে নাজাত পাওয়ার জন্য আমরা কি নিজেদের তৈরি করতে পেরেছি? তাহলে কোন হিসেবে আমরা নিজেদের সফলতা পাওয়ার যোগ্য বলে দাবি করি?
সফলতা দেওয়ার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তো শর্ত জুড়েই দিয়েছেন, কুরআনে হাকিমে তিনি ঘোষণা করছেন,
“তোমাদের মধ্যে
যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের ওয়াদা দিয়েছেন, তাদের অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন, যেমন তিনি শাসন কর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের
পূর্ববর্তীদের। তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং
ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদের শান্তি দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার
সাথে কাউকে শরিক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য।” সূরা নূর : ৫৫
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *